মোস্তফা কামাল গাজী : সম্রাট আকবর মুঘল ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ও প্রতাপশালী একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি ছিলেন দ্বীনে ইলাহির প্রবর্তক। প্রায় সাড়ে তিন শত বছরের মুঘল ইতিহাসে আকবরই শাসন করেছেন অর্ধশতাব্দীরও বেশি (৫৩ বছর)। এত বেশি সময় ধরে অন্য কোনো সম্রাট ভারত শাসন করতে পারেননি। ৬৩ বছর বয়সে ১৬০৫ সালের ১৫ অক্টোবর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ভারত উপমহাদেশের শাসক ছিলেন। এরপরই আরোঙ্গজেবের অবস্থান। তিনি শাসন করেছেন ৪৯ বছর।
মুঘল আমলে আগ্রা ছিল মুসলমানদের রাজধানী। আগ্রার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মুঘল ইতিহাসের অনন্য সব অধ্যায়। মুঘল ইতিহাসের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব সৌন্দর্য ও মহিমাকে উপলব্ধি করা যায় আগ্রা এসে। মুঘল আমলে নির্মিত আশ্চর্য সৌধগুলোর মধ্যে একটি হলো সিকান্দ্রা। মুঘল সম্রাটদের জীবদ্দশায় নিজের সমাধিস্থল নির্ধারণ করে যাওটা ছিল শখের বিষয়। সম্রাট আকবর নিজের সমাধিস্থল হিসেবে চয়ন করেন সিকান্দ্রাকে। তখন জায়গাটা ছিল জনমানবহীন নির্জন একটি জঙ্গল। পাখিদের কলকাকলিতে ছিল সদা মুখর। বেশ নিরিবিলি হওয়ায় জায়গাটা হয়তো সম্রাটের খুব পছন্দ হয়েছিল। জঙ্গল পরিষ্কার করে ১৬০৬ সালে ১১৯ একর জমিজুড়ে সৌধের নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৬১৩ সালে তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন পুত্র জাহাঙ্গীর। পিতার পরিকল্পিত নকশা ধরেই নির্মাণ করেন তিনি সুবিশাল এই সৌধ।
আমাদের মাদরাসা থেকে সিকান্দ্রা খুব বেশি দূরের পথ নয়। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে আমরা পনেরজন মিলে রওনা হলাম সেখানে। যে সম্রাট এত দাপটের সাথে পুরো ভারত শাসন করেছেন, তার সমাধিটা এত কাছে থেকেও না দেখে পারা যায় না। ট্যাক্সিতে চড়ে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম সিকান্দ্রা গেটে। প্রধান সড়কের পাশেই এর অবস্থান। একসময়কার নির্জন জায়গাটি এখন জনকোলাহলে পূর্ণ। তবে তাজমহলের মতো এতটা ভিড় নেই এখানে। বিশ রুপি করে টিকিটমূল্য। টিকিট কাউন্টার থেকে মূল গেটে যেতে একটুখানি পায়ে চলা পথ। দুই পাশে সারি সারি বাগান। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর চার পাশ। যেন সেই চার শ’ বছর আগের সিকান্দ্রা। বাগানের সৌরভ গায়ে মাখতে মাখতে পৌঁছলাম মূল গেটে। হুবহু তাজমহলের গেটের মতো সুবিশাল। লাল বেলে পাথরে নির্মিত। অসাধারণ কারুকার্য খচিত। চার পাশে চারটি উঁচু মিনার। শোনা যায়, সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছেন আকবরের সমাধিস্থল দেখে।
টিকিট দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চার দিকে চারটি গেট থাকলেও আজ কেবল প্রধান গেটটি উন্মুক্ত। প্রতিটি গেটেই রয়েছে অসাধারণ সুন্দর নকশা, যা লাল-নীল বা সোনালি রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। গেট থেকে মর্মর পাথরে নির্মিত বড় একটি রাস্তা চলে গেছে সমাধিস্থল বরাবর। দুই পাশে বিশাল খালি প্রান্তর। সেখানে বিচরণ করছে বেশ কিছু চিত্রা হরিণ। কয়েকজন রাখাল ওগুলো দেখাশুনা করছে। দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্যে হরিণগুলো রাখা হয়েছে। কোমল রোদ্দুর মাথায় নিয়ে হেঁটে চললাম সমাধিস্থলে। সামনে একটি স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। চার পাশে বড় বড় বারান্দাবিশিষ্ট সমাধির সৌধটি বিশাল আকৃতির। পুরোটাই শ্বেতপাথর, লালপাথর ও জেডপাথরে তৈরি। মুঘল সম্রাটদের অন্যান্য স্থাপত্যের মতো এর দেয়ালগুলোও সুন্দর কারুকার্য খচিত। শত শত বছরের মুসলিম ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে গেল প্রাসাদটা দেখে। প্রবেশপথের দেয়ালে সূরা মুলক খোদাই করে লেখা হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌধটি দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করে তোলে মুহূর্তেই। মূল কবর একটি অন্ধকারচ্ছন্ন কক্ষের ভেতর। সেখানে যাওয়ার পথটিও কেমন অন্ধকার আর ভুতুড়ে। জুতা বাইরে রেখে প্রবেশ করলাম সেখানে। ভয়ে গা ছমছম করে উঠছিল হঠাৎ হঠাৎ।
ভেতরে চলছিল আলো-আঁধারির খেলা। কবরটি মর্মর পাথরে আবৃত। সমাধির ঠিক ওপর বরাবর মিটিমিটি জ্বলছিল পুরনো আমলের একটি ঝাড়বাতি। সে আলোয় দেখলাম কবরের গায়ে কুরআনের কয়েকটি আয়াত লেখা রয়েছে। দাঁড়িয়ে তা পাঠ করলাম। ঝাড়বাতি ছাড়া ভেতরে অন্য আলো জ্বালানো বা মোবাইলে ছবি ওঠানো নিষেধ। কেমন যেন গুমোট এক নির্জনতা ছেয়ে আছে চার পাশে। একটু আওয়াজ হলেই ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি ভেসে আসে। মনে হচ্ছিল কক্ষটিও একটি অন্ধকারময় কবর। খুব অসহায় আর নিঃসঙ্গ মনে হলো একসময়কার প্রতাপশালী সম্রাটকে। কিছু ওজিফা পাঠ করে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। বারান্দা ঘেঁষে দুই পাশে আরো তিনটি কবর। শিলালিপির লেখা পড়ে বুঝলাম, আকবরের এক বোন এবং শাহজাহানের এক ছেলে ও এক মেয়ের সমাধি এগুলো। আকবর চেয়েছিলেন, তার সব বংশধরের কবর এখানে হবে। কিন্তু তার সে আশা তার সন্তানেরা পূর্ণ করেনি। একেক জনের সমাধি একেক জায়গায় হয়েছে। পুত্র জাহাঙ্গীর শুয়ে আছেন লাহোরে, শাহজাহান তাজমহলে, আরোঙ্গজেব অওরঙ্গবাদে, বাহাদুর শাহ রেঙ্গুনে আর বাবর আফগানিস্তানে। নিতান্ত নিঃসঙ্গ হয়ে একাকী নিভৃতে শুয়ে আছেন সম্রাট আকবর।
ঘন জঙ্গলে ছাওয়া জায়গাটিতে সম্রাট শিকারে আসতেন মাঝেমধ্যে। বিশ্রাম নিতেন এখানে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিশ্রাম করার ঘরটি এখনো আছে। নাম কাচমহল। শোনা যায়, কাচমহল যে পাথর দিয়ে তৈরি তার থেকে রাতের বেলা রঙিন আলো বের হতো। একসময় এতে ছিল কাচের কারুকাজও। সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক সৌন্দর্য। সমাধির ডানে-বামে বড় গেট দু’টিও বেশ চমৎকার। প্রধান গেটের মতোই কারুকার্যবিশিষ্ট ও সুবিশাল। কাছ থেকে এর সৌন্দর্যও দেখলাম মনভরে। আশপাশে ফলফলাদি ও বনজ ফুলের গাছ। পাখিরা ডাকছে মধুর স্বরে। সে দিন সিকান্দ্রার বৈকালীন অপরূপ সৌন্দর্য দেখে হারিয়েছিলাম যেন নন্দন মুগ্ধতায়।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। গোধূলি রঙে ছেয়ে আসছে আকবরের পুরো সিকান্দ্রা। পাখির কলকাকলি আরো বেড়ে গেছে। নীড়ে ফেরার সুখে মত্ত তারা। আমরাও ফিরে চললাম মাদরাসার উদ্দেশে। আর পেছনে রেখে গেলাম সম্রাট আকবরের শত বছরের ঐতিহ্য সিকান্দ্রাকে।