মোহাম্মদ হাসান শরীফ : আগের রাতে দৈনিক র্ফাজ পত্রিকা অফিসে ছিল সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় ও শেষে ডিনারের ব্যবস্থা। উর্দু পত্রিকা। ছাপা হয় আট পৃষ্ঠায়, তবে ইন্টারনেট সংস্করণ ১২ পৃষ্ঠার। সম্পাদক মুখতার নাকভি বেশ সজ্জন মানুষ। বর্ষীয়ান লোকটি আমাদের সমাদর করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে ঘরে বসার ব্যবস্থা করেছেন, তা তার আন্তরিকতার সাথে একেবারে বেমানান। এসিতো দূরের কথা, সিলিং ফ্যান পর্যন্ত নেই। এমন অবস্থায় আমাদের দেশে হলে ভাড়া করে হলেও স্ট্যান্ড ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়। তাও করা হয়নি। ফলে যা হবার তা-ই হলো। কোট-টাই পরা আমাদের দলের এক সদস্য দরদর করে বয়ে চলা ঘামের সাথে প্রচণ্ড ক্ষোভও উগড়ে দিলেন। বাংলাদেশের মিডিয়া যে অনেক এগিয়ে গেছে, সে কথাটি কয়েকবার আয়োজকদের জানিয়ে দিলেন।

পর দিন রাতে আরেক অনুষ্ঠান। এবার তিনি বিস্ময়ে হতবাক। আমাদের দলের কেউ কেউ বলছিলেন, আগের দিনের ‘গরম’ ঠাণ্ডা করতেই এই ব্যবস্থা। তবে জানা গেল, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান সফরে যাওয়া প্রায় প্রতিটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলকেই এখানে আনা হয়। আরব সাগরের মুগ্ধতা শিহরণ জাগায়।

অবশ্য ওই দিন বিকেলেই করাচির বিখ্যাত ক্লিফটন বিচেও ঘোরা হয়েছিল। সাগরের পানিতে মাখামাখির কাজও হয়েছিল বেশ। ঘোড়া, উটের ব্যবস্থা ছিল। তবে এ স্থানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

দো দরিয়া। জায়গাটির নাম। গাড়ি থেকে নেমে বোঝার উপায় ছিল না, সামনে এমন মুগ্ধতা অপেক্ষা করছে। দি ফিন্যান্সিয়াল ডেইলির নির্বাহী সম্পাদক মনজুর নাকভি স্বাগত জানালেন। তার সাথে আগের দিনই পরিচয় হয়েছিল র্ফাজ পত্রিকা অফিসে। ওই দিন তেমন কিছু বলেননি। আজকের মেজবান তিনি। আগের দিনই আরেক তরুণের সাথে ওই অফিসে দেখা হয়েছিল। সাংবাদিক ভেবে পরিচয় জানতে চাইলে জানিয়েছিলেন, তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট। কথা বলতে আগ্রহী মনে হয়নি। তবে এ দিন মানজুর নাকভি এক ফাঁকে তার ‘ক্রাউন প্রিন্স’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাথে প্রিন্সেসও ছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাত করতে ‘কুইন’ও না এসে পারেননি।
কিন্তু কেন একে বলা হয় দো দরিয়া? আশপাশে পর্যন্ত দুটি কেন, একটি নদীও চোখে পড়ল না। আছে কেবল সাগর – আরব সাগর। দুই দিকেই।

অবশ্য নামকরণ নিয়ে জটিলতা কাটতে বেশি সময় লাগেনি। দরিয়া মানে যেমন নদী, ফারসিতে দরিয়া অর্থ সাগর। দো দরিয়ার অর্থ হয় দুই সাগর। দুই দিকেই যে আরব সাগর। কাজেই এর নাম দো দরিয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
বর্তমানে করাচির বেশ সুপরিচিত পর্যটন কেন্দ্র দো দরিয়া। আমরা যখন সন্ধ্যার পর সেখানে পৌঁছালাম, তখনই বেশ জমজমাট। রাত যত বাড়তে লাগল, লোক সমাগম তত বেশি দেখা গেল। আকাশে ভরাট চাঁদ। জ্যোৎস্নার মাখামাখি। সাগরের হালকা ঢেউগুলোতে সেই জ্যোৎস্না অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়াচ্ছিল। সাগরের উতাল হাওয়ায় সেই ঢেউয়ে আমরা সবাই যখন মুগ্ধ, তখনই দেখা গেল, আকাশে ডানা মেলে উড়ছে স্বপ্নপরীরা। একটি দুটি নয়, অসংখ্য। ছুটছে, তবে হাতের নাগালে আসার সম্ভাবনা নেই। আমাদের জিজ্ঞাসু মুখ দেখে আয়োজকদের একজন বললেন, এগুলো সি-গাল। দো দরিয়া মেজবান। অসীম আকাশে ডানা মেলে অতিথিদের স্বাগত জানায়। চাঁদের আলো গায়ে মেখে স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যায় তারা। কল্পনার রাজ্যে পাড়ি দিতে আমাদেরও কোনো আপত্তি ছিল না। তবে তা রেস্তোরাঁর পাটাতনে দাঁড়িয়ে।

ডিনারের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চলল। সমসাময়িক অনেক বিষয় নিয়েই কথা ওঠল। তবে সবার মধ্যেই দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ গুরুত্ব পেল। এই পর্যায় এটিই হয়তো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
স্থানটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ’৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে। যতই জনপ্রিয় হয়, সাগর ঘেঁসে ততই বাড়তে থাকে রেস্তোরাঁর সংখ্যা। আল হাবিব, মিরেজ, দেশি হাট, সাজ্জাদ রেস্টুরেন্ট, রিভার সাইড ইত্যাদি নামে অনেক রেস্তোরাঁ জমজমাট উপস্থিতি জাহির করছে। পাকিস্তানে সম্ভবত এটিই একমাত্র ফুড স্ট্রিট। অবশ্য কেবল খাওয়া নয়, মাছ ধরার শখও অনেকে পূরণ করে এখানে এসে।

মানজুর নাকভি জানালেন একটি আশ্চর্য ঘটনা। এখানে নাকি সাগর উত্তাল হয় না, ঝড় কখনো আছড়ে পড়ে না। ফলে কাঠের তৈরি রেস্তোরাঁগুলো অবলীলায় টিকে আছে। কোনো ধরনের আশঙ্কা ছাড়াই তারা প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

তবে এর অন্ধকার দিকও আছে। যেখানেই অর্থ-বিত্ত আর আলোর ঝলকানি থাকবে, সেখানে অন্ধকারের পঙ্কিলতাও অপরিহার্যভাবে হাজির হবে। আলো-আঁধারিতে যত অপকর্ম হতে পারে কিংবা পেশীর জোর দেখানোর জন্য কারো কারো কাছে এটিই হতে পারে কারো কারো জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা।

তবে করাচির গর্ব করার মতো স্থানটির ভাগ্য এখন পলকা সুতোয় ঝুলছে। ‘ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটি’ এর মধ্যেই উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। পাকিস্তানি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ১৭টি রেস্তোরাঁর মধ্যে তিনটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাকিগুলোও শিগগিরই একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ, সেখানে অভিজাত আবাসিক এলাকা আর বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এতে অবশ্য অনেক করাচিবাসীই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

ইসলামাবাদ আর লাহোরের মতো অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকা নগরীর তুলনায় পাকিস্তানের সাবেক এই রাজধানীর জৌলুস অনেকাংশেই ম্লান। কিন্তু দো দরিয়া তাদেরকে গর্ব করার একটি মাধ্যম দিয়েছে। সেটিও যদি না থাকে, তবে তা ভালো লাগার কথা নয়। সামাজিক মাধ্যমে তাদের এ নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। বর্তমান কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হলে, প্রকৃতির একটি উপহার থেকেই তাদের বঞ্চিত করা হবে। অবশ্য কেউ কেউ এখনো আশাবাদী। হয়তো কোনোভাবে এটি টিকে যাবে। সাগর পাড়ে চাঁদের আলোয় ডানা মেলা স্বপ্ন দেখার সুযোগ অবারিতই থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here