নির্বাচনের চার দিন আগে রহস্যজনক মামলা দায়ের আর পুলিশের ব্যাপক অভিযানের মুখে বরিশালের বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারছেন না। ২৪ ঘণ্টায় বিএনপির ২৪ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মী ও মামলার আসামিদের মধ্যে অধিকাংশই হলেন বিএনপির পোলিং এজেন্ট এবং ভোট কেন্দ্রে দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তি। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও গ্রেফতার অভিযান চলছে।
সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব এবং বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান বলেন, পুলিশের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকলে ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের মতো দলীয় লোক পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে। জামায়াতের জেলা নায়েবে আমীর আমিনুল ইসলাম খসরু বলেন, দিনে-রাতে দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, সুনির্দিষ্ট মামলা ও ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হচ্ছে না বলেও তারা জানান। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। এছাড়া প্রশাসনের দায়িত্ব প্রশাসন পালন করবে, সেটাই স্বাভাবিক।
বিএনপি নেতা এবায়েদুল হক চান বলেন, যে কোনো উপায়ে বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে রাখতে ক্ষমতাসীন দল সব রকম কৌশল অবলম্বন করছে। আর এক্ষেত্রে তারা পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে। বরিশালে অহেতুক হয়রানি আর গ্রেফতার অভিযান হতে পারে ভেবে- আগেভাগেই উচ্চ আদালতে রিট করে আমরা নির্দেশনা নিয়ে এসেছি। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নির্বাচনকালে মামলা অথবা ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেফতার ও অহেতুক হয়রানি করা যাবে না।
বিষয়টি নিয়ে যখন আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে খবর আসে অদ্ভুত এক মামলার। বুধবার নগরীর কাউনিয়া থানায় করা মামলায় বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহিনসহ ৩৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২৪ জুলাই রাত দেড়টার দিকে মামলার বাদী বেল্লাল হোসেনসহ তার লোকজনকে মারধর ও নগদ সাড়ে ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে।
চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মহাবাজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মামলায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জেলা যুবদল সভাপতিসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী রয়েছেন। তারা সবাই বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাদের মধ্যে ১০ জনের সিটি নির্বাচনে দলীয় পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করার কথা রয়েছে। ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবেন এরকম কয়েকজনের নামও রয়েছে সেখানে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর হাউজিং এলাকায় ধানের শীষের পক্ষে গণসংযোগ করার সময় পাঁচ কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দেয়ার পর রহস্যজনক মামলাটি সম্পর্কে নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। বিএনপির যেসব নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছেন, তাদের এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হচ্ছে। অজামিনযোগ্য ধারা হওয়ায় তাদের কেউ ছাড়াও পাচ্ছে না।
মামলার আসামি জেলা বিএনপির (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহিন গোপন স্থান থেকে মোবাইল ফোনে বলেন, কেবল একটি মামলা নয়, নগরীর বিমানবন্দর থানায় আরেকটি এ ধরনের রহস্যজনক মামলা হয়েছে। রুবেল নামে এক ব্যক্তি এই মামলার বাদী। দ্বিতীয় এই মামলাতেও হামলা, মারধর চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া বিএনপির ২৪ নেতাকর্মীকে উল্লিখিত দুটি মামলাসহ পুরোনো বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ২-৩ দিন ধরে যে পরিস্থিতি, তাতে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বুধবার রাত থেকে বাসাবাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী। পুলিশের হয়রানি ও গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা।
বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের নেতাকর্মীরাও একইভাবে দমনপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তাদের বাড়ি বাড়ি পুলিশি অভিযান চালাচ্ছে। দলের জেলা নায়েবে আমীর আমিনুল ইসলাম খসরু বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর ২৪নং ওয়ার্ড থেকে তাদের কর্মী আনোয়ার হোসেন মন্টুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে ৯ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলো।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বরিশালে প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করছে। যেভাবে আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে ভোটারদের মধ্যে স্বস্তি আসবে না এবং ভোটও অবাধ হবে না।
বিএনপির এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, অন্য দুই সিটির তুলনায় বরিশালের নির্বাচনী পরিবেশ অত্যন্ত ভালো। এখানে হামলা নেই, মারধর নেই, কোনো অশান্তি নেই। মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিএনপি এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে ঘোলাটে করতে চাইছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদিক বলেন, এটা তো প্রশাসনের ব্যাপার। আমি তো প্রশাসনের কেউ নই। তবে আমি বলব, এখনকার পরিস্থিতি খুবই ভালো। আমি আহ্বান জানাব, ভোটাররা যেন ৩০ জুলাই ভোট কেন্দ্রে যান এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। তিনি জানান, তার কাছে খবর আছে একটি পক্ষ ভোটারদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর কাউনিয়া, এয়ারপোর্ট ও কোতোয়ালি থানার তিন ওসি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট মামলা ও ওয়ারেন্ট যাদের নামে, কেবল তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই।