১৯৭১ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ দিয়ে বড় পর্দায় পা রাখেন বরুণ চন্দ। এরপর ‘হীরের আংটি’, ‘লাল দরজা’, ‘এলার চার অধ্যায়’ প্রভৃতি কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন নিয়মিত। বলিউডেও কাজ করেছেন তিনি, উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘লুটেরা’র কথা। এ পর্যন্ত প্রায় ২২টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, করে চলেছেন এখনো।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার জয় চন্দ্র ঘোষ লেনের পথ ধরে হাঁটছিলেন বরুণ চন্দ, দেশভাগ নিয়ে নির্মাতা স্বজন মাঝির ছোট দৈর্ঘ্যের ‘গল্প সংক্ষেপ’ ছবিতে অভিনয়ের অংশ হিসেবে। শৈশব কেটেছে এই পুরান ঢাকাতেই।

দেশভাগের আগে ১৯৪৪ সালে কলকাতায় বসত গড়া বরুণ চন্দকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ছবিটির গল্প। শুটিংয়ের মাঝে সময় করে কথা বলেছেন পার্থ সনজয়ের সঙ্গে।

প্রশ্ন : শেষ কবে ঢাকায় এসেছিলেন?

বরুণ চন্দ : ‘রিনা ব্রাউন’ ছবিটা করেছিলাম ২০১৫ সালে। ডিসেম্বর মাসে এসেছিলাম তখন। দিন দশ-পনেরো ছিলাম। আমার কাছে খুব আলাদা অভিজ্ঞতা। তারপর এই এলাম। দুই বছর পর।

প্রশ্ন : ফেলে আসা জন্ম শহরটাতে আসতে কেমন লাগে?

বরুণ চন্দ : আমার তো ঢাকায় জন্ম। পুরান ঢাকা। সদরঘাটের খুব কাছে। জুবিলী স্কুল। বাংলাবাজার। সেখানে আমার জন্ম। শৈশব বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকা-ময়মনসিংহ এসব মিশিয়ে। মানে একদম বাংলাদেশ যেটা এখন। সেই বাংলায় আমার শৈশব কেটেছে। ১৯৪৪ সালে আমি চলে যাই ওপারে।

প্রশ্ন : একটা ছোট দৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করতেই তো এবার আসা, যার গল্প দেশভাগ নিয়ে।

বরুণ চন্দ : গল্পটা অনেকটা আমাকে নিয়েই।

প্রশ্ন : এখানে তাহলে কি অভিনয় করতে হচ্ছে না আপনাকে, যেহেতু নিজের গল্প।

বরুন চন্দ : আমার কাছে অভিনয়টাই কিন্তু নিজেকে বারবার খুঁজে পাওয়া, ভিন্ন ভিন্নভাবে। অভিনয় বলতে কিন্তু তাই বোঝায়। এটাও তাই। গোয়িং ব্যাক টু ওয়ানস রুটস। ছোটবেলার শৈশবের কথা মনে করা। এটা নিয়েই ছবিটা।

প্রশ্ন : আপনার অভিনয় জীবনের শুরুটা সেই ১৯৭১ সালে। সত্যজিত রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির মধ্য দিয়ে।

বরুণ চন্দ : অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল। শখ ছিল, সত্যজিৎ বাবুর ছবিতে অভিনয় করা যায় যদি তাহলে নাথিং লাইক ইট। মানে ইটস আ ওয়ান টাইম লাইফ এক্সপেরিয়েন্স, যেটা প্রত্যেকের বেলাতেই সত্যি আমার ধারণা। মানে মানিকদার ছবিতে অভিনয় করা ইটস আ ওয়ানস ইন এ লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স। অ্যাচিভমেন্ট কী না জানি না।

প্রশ্ন : আপনি তো অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন। অনেককে কাছ থেকে দেখেছেন। সত্যজিৎ রায় যে মানের পরিচালক, তাঁর সঙ্গে অন্যদের কি তুলনা হয়?

বরুণ চন্দ : আমার কাছে মনে হয়েছে, সত্যজিৎ রায় যে পর্যায়ের পরিচালক, তিনি যে আসনে রয়েছেন, অন্যরা বোধ হয় তা নয়। কতগুলো ব্যাপার যেমন ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে সাংঘাতিক জোর ইত্যাদি ছিল। কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে মানিকদা কমপ্লিট ডিরেক্টর। তিনিই শ্রেষ্ঠ।

প্রশ্ন : ঋত্বিক প্রসঙ্গে সত্যজিৎ কী ভাবতেন?

বরুণ চন্দ : ঋত্বিক ঘটক যখন মারা যান, তখন মানিকদা ‘অপোজিট এডিটরিয়ালে’ একটা অসামান্য আর্টিকেল লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ওপর। টাইটেল ছিল ‘দ্য আনটাচড ডায়মন্ড’। উনি তুলনা করেছিলেন, ঋত্বিক বাবুর মধ্যে যে স্ট্রেংথ বা পাওয়ার ছিল, সেটা এক রকম ডায়মন্ড। কিন্তু ডায়মন্ড থেকে তখনই আলোর বিচ্ছুরণ হয় যখন কাটিংটা প্রফেশনালি করা হয়। সেটা কিন্তু আনফরচুনেটলি ঋত্বিক ঘটকের বেলায় হয়নি। এটাই তারঁ আর্টিকেলের প্রতিপাদ্য ছিল।

প্রশ্ন : এখনকার নির্মাতাদের নিয়ে কী বলবেন?

বরুণ চন্দ : সত্যজিৎ বাবু বা মৃণাল সেন যে গল্প নিয়ে বা যে রকমের ছবি করতেন, ছবির মধ্যে কোথাও না কোথাও কিছু একটা সোশ্যাল কমিউনিকেশন বা একটা কিছু বক্তব্য বিষয় ছিল।

যেমন আপনি ‘বিসর্জন’ বলতে পারেন কৌশিকের। কিংবা ‘ছায়া ও ছবি’ যেটা একদম রিসেন্টলি হলো। আগেকার ছবি যদি দেখেন আর এখনকার ছবি দেখেন, আলাদা ছবি ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিপাদ্য আছে কি? সৃজিতের ছবিতে আলাদা কিছু আছে কি? যাতে বলা যায়, এটি অরজিনাল।

আমি তো বলব যে, এমনকি অগ্রদূত, তপন সিনহা—এরা তো প্রত্যেকে একেবারে… ঠিক আছে কমার্শিয়াল ইলিমেন্ট রয়েছে তাতে, কিন্তু মূল ব্যাপারটাও ছিল। একটা বক্তব্য ছিল। সেটা আজকে কোথায়?

‘চতুষ্কোণ’ সাকসেসফুল ছবি। আমি অভিনয় করেছি তাতে। খুব ভালো। লোকে প্রশংসা করে। বলে, চতুষ্কোণে আপনার গলাটা অসাধারণ ছিল। ফাইন। ঠিক আছে। কিন্তু ছবিটাতে কি সেই রকম কোনো বক্তব্য আছে? আমার কাছে তো মনে হয়েছে, ইটস আ এন্টারটেইনার।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা নানা রকম হচ্ছে কিন্তু। ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। গল্প বলার ভঙ্গি নিয়ে নিরীক্ষা হচ্ছে। কিছু কিছু স্টোরি নিয়েও পরীক্ষা হচ্ছে। আমি বলব ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবিটার কথা। যদি দেখে থাকেন, আদিত্য বিক্রম খুবই আলাদা।

প্রশ্ন : ঢালিউডের ছবি নিয়ে কী বলবেন? দেখা হয়?

বরুণ চন্দ : মসলা রয়েছে। বিরাট মসলা রয়েছে এখানে। খুব কম দেশ রয়েছে যে দুবার করে স্বাধীনতা পেতে হয়েছে। একবার ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া। তারপর আবার ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতনের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া। খুব কম দেশেই এ রকম হয়েছে। তাই গল্প বা ম্যাটেরিয়াল তো চারপাশে ছড়ানো। সেটা নিয়ে সার্থক ছবি হচ্ছে কী না, সেটা দেখা হতে পারে।

আবার এমনও হতে পারে, ওই ছবি করলে পরে দর্শক পাওয়া গেল না। কারণ, দর্শকরা চান এন্টারটেইনমেন্ট। আমি দুই ঘণ্টা গিয়ে আনন্দ করে চলে এলাম। আমি চিন্তা করতে চাই না। আমি এমন ছবি দেখতে চাই না, যেটা আমাকে চিন্তান্বিত করে বাড়ি ফেরাবে। হতেই পারে। হয়তো সে রকম সময় এখনো আসেনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here