জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
১৯৩০ সালে ২০ বছরে পা রাখলাম আমি, আর নোটিশ পেলাম— আর্মি নিয়োগ পরীক্ষায় ফিজিক্যাল টেস্ট দিতে হাজির হওয়ার। ফিজিক্যাল টেস্টটি নেওয়া হবে উশিগোমে অবস্থিত প্রাইমারি স্কুলে।
আমি সেই অফিসারটির সামনে ‘অ্যাটেনশন’ হয়ে দাঁড়ালাম, যিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি সেই ইয়ুতাকা কুরোসাওয়ার ছেলে, যিনি তোয়ামা একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন এবং একজন আর্মি অফিসার হিসেবে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন?’ জবাবে বললাম, ‘ইয়েস, স্যার।’ জানতে চাইলেন, ‘বাবা ভালো আছে তোমার?’ ‘ইয়েস, স্যার।’ ‘আমি তোমার বাবার ছাত্র ছিলাম। তাঁকে আমার সালাম জানিও।’ ‘ইয়েস, স্যার।’ ‘তুমি কী হতে চাও?’ অফিসারটি জানতে চাইলেন। জবাব দিলাম, ‘আমি একজন পেইন্টার, স্যার।’ [বলিনি, আমি ‘সর্বহারা শিল্পী’]। ‘আচ্ছা’—বললেন অফিসার, ‘মিলিটারি সার্ভিসের বাইরেও এ দেশের জন্য সেবা দেওয়ার আরো অনেক পথ রয়েছে। যাও, তা-ই করো।’ জবাবে বললাম, ‘ইয়েস, স্যার।’ অফিসার বলেই চললেন, ‘কিন্তু তোমাকে অনেক রোগা দেখাচ্ছে। তা ছাড়া তোমার দেহভঙ্গিও খারাপ। তোমার বডি-বিল্ডিং এক্সারসাইজও করা উচিত। এ ধরনের এক্সারসাইজ তোমার বাজে দেহভঙ্গি শুধরে তোমাকে পরিপূর্ণ করে তুলবে।’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজে আমাকে পুরো এক্সারসাইজটি করে দেখালেন। দৃশ্যতই আমাকে তখনো বয়সের তুলনায় রোগাটে দেখাত। অবশ্য, অফিসারটি যেহেতু অনেকক্ষণ ধরে নিজের ডেস্কে বসে ছিলেন, ফলে তারও নিশ্চয়ই খানিকটা গা-ঝাড়া দেওয়ার দরকার পড়েছিল।
ফিজিক্যাল টেস্টের শেষ বেলায়, আমাকে একজন ওয়ারেন্ট অফিসারের কাছে যেতে বলা হলো, যিনি ফর্মের স্তূপ জমে থাকা এক ডেস্কে বসে ছিলেন। এই লোকটি ক্রুদ্ধ চোখে, কটমট করে আপাদমস্তক দেখলেন আমাকে। আর বললেন, ‘মিলিটারি সার্ভিসে এসে তোমার কাজ নেই!’ তার মানে, ঘটনা এটাই। প্যাসিফিক যুদ্ধে জাপান হারার দ্বারপ্রান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমার আর ডাক আসেনি। আমেরিকান বিমান হামলায় টোকিও শহরটি একেবারেই ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার এবং আমি ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার পর ডাকটি এসেছিল। যেহেতু মিলিটারি সার্ভিসে আমার একমাত্র প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ঘটনা এটি, ফলে একে আমি বেশ ভালোভাবেই বর্ণনা করতে পারব।
এ সময়টিতে পৌঁছে অধিকাংশ মানুষই হয় শারীরিক পঙ্গুত্ব, নয়তো নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছিলেন। রোলকল করার সময় আমাদের সবার কাছে নিজের ‘সার্ভিস ব্যাগ’ (যেটিতে ছিল মিলিটারি সার্ভিসে যাওয়ার জন্য অতি আবশ্যক জিনিসপত্র) থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। এই সার্ভিস ব্যাগগুলো তল্লাশি হতো। ইন্সপেক্টিং অফিসার আমার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই লোকটি সবকিছুই নিয়ে এসেছে।’ এটা তো হওয়ারই ছিল। কেননা, ব্যাগটি গুছিয়ে দিয়েছিলেন আমার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, যার মিলিটারি সার্ভিসের অভিজ্ঞতা আগেই ছিল। আমি সেখানে ‘অ্যাটেনশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এ সত্য জেনেই। ইন্সপেক্টিং অফিসার ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘স্যালুট! স্যালুট!’ আমি ঝটপট নিজেকে জড়ো করে, স্যালুট দিলাম তাঁকে। তিনি ফিরতি-স্যালুট দিয়ে এগিয়ে গেলেন লাইনের পরের লোকটির কাছে।
আমার খারাপ লাগছিল এই ভেবে, সার্ভিস ব্যাগের জন্য একমুহূর্ত আগেই প্রশংসা পরা লোকটিই কি না পরমুহূর্তেই আমাকে ভর্ৎসনা করলেন! এ কথা যখন ভাবছিলাম, তখনই তার চিৎকার ভেসে এলো কানে, ‘তোমার সার্ভিস ব্যাগের হলোটা কী?’ চোখের কোণ দিয়ে কোনোরকমে দেখলাম, ইন্সপেক্টরটি আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন। এক জোড়া ছেঁড়া আন্ডারপ্যান্টস নিয়ে এসেছেন লোকটি—সেগুলো তিনি নিজের প্যান্টের সঙ্গে এমনভাবে সেলাই করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, যেন খরগোশের লেজের মতো ঝুলে পড়েছে। লোকটি ইন্সপেক্টরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললেন, ‘সার্ভিস ব্যাগ আবার কী জিনিস?’ ইন্সপেক্টরের ঠিক পেছনেই থাকা মিলিটারি-পুলিশ অফিসারটি ঝটপট সামনে এসে, খরগোশ-লেজের লোকটিকে আঘাত করলেন।
ঠিক সে মুহূর্তেই বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠল। সেটি ছিল ইয়োকোহামায় ভয়াবহ বোমা হামলার সূচনা মুহূর্ত। মিলিটারি সার্ভিসের সঙ্গে আমার সংযোগের সমাপ্তি মুহূর্তও ছিল এটিই। তবে প্রায়শই অবাক হয়ে ভাবি, আমাকে যদি যোগ দিতে হতো যুদ্ধে— কী হতো তাহলে? মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সামরিক প্রশিক্ষণে ফেল করেছিলাম আমি; অফিসারের কাছ থেকে পারদর্শিতার কোনো সার্টিফিকেট পাইনি। আর্মিতে ভাসমান হওয়ার কোনো উপায় ছিল না আমার পক্ষে। সবচেয়ে বড় কথা, কেইকা মিডল স্কুলে যে আর্মি অফিসারটির অধীনে আমাকে পাঠ নিতে হয়েছিল, যদি তাঁর অধীনেই এখানে চলতে হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তা টেনে আনত আমার যবনিকা। এখনো এসব ভাবতে গেলে শিউরে উঠি আমি। আর্মি ফিজিক্যাল টেস্টে যে অফিসারটি আমাকে রেহাই দিয়েছিলেন, তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানানো উচিত। কিংবা সম্ভবত নিজের বাবাকেই এই ধন্যবাদ জানানো উচিত আমার।